দুই মুখ
মূল লেখক: ডঃ মধুছন্দা চক্রবর্তী
মীরা আর স্যান্ডির বিয়ের বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। ওরা ব্যাঙ্গালোরের এক অভিজাত এলাকায় থাকত। মীরা এক স্কুলে শিক্ষিকা ছিল, আর স্যান্ডি এক বহুজাতিক সংস্থায় উঁচু পদে কর্মরত ছিল। সম্প্রতিই ওর পদোন্নতি হয়েছিল। বাইরে থেকে দেখলে মনে হতো ওরা খুব সুখের জীবন কাটাচ্ছে। বাইরের দুনিয়ার কাছে স্যান্ডি ছিল এক আদর্শ স্বামী। সামাজিক অনুষ্ঠানে সে মীরার হাত ধরে বলত, "আমার মীরা ঘরটাকে স্বর্গ বানিয়ে রেখেছে, সবটাই ওর পরিশ্রমের ফল।" লোকজনে মীরাকে খুব ভাগ্যবতী মনে করত।
কিন্তু ঘরের চার দেয়ালের ভেতরে স্যান্ডির মুখোশটা খুলে যেত। স্যান্ডির খিটখিটে স্বভাব সকালের প্রথম আলোর সাথেই শুরু হতো। চায়ের টেবিলে ছোটখাটো বিষয়েও সে চিৎকার করে মেজাজ দেখাত। মীরা স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হতেই স্যান্ডির চা আর জলখাবার সাজিয়ে দিত, কিন্তু স্যান্ডি কোনো না কোনো খুঁত বের করত। কখনো জলখাবার পছন্দ না হওয়া, তো কখনো চা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, এমনকি দুই-তিন মিনিটের দেরি হলেও সে চিৎকার করত। মীরা রোজ রাতে ঘর আর রান্নাঘর গুছিয়ে যখন শুতে আসত তখন রাত ১২টা বেজে যেত, আবার পরদিন ভোর ৬টায় উঠে সব গোছগাছ শুরু করত। আধো ঘুম আর ক্লান্তি নিয়েও সে চুপচাপ কাজ করত। মীরা জানত স্যান্ডি রোজই এমন করে, কিন্তু কোনোদিন মীরা যদি ক্লান্ত হয়ে বলত যে সেও সারাদিন কাজ করেছে, স্যান্ডি তাচ্ছিল্যের সুরে বলত, "হ্যাঁ, তুমি তো আমাকে স্বর্গে নিয়ে এসেছ! তোমার এই মহান সেবার জন্য নিশ্চয়ই আমার ঋণী থাকা উচিত, তাই না?"
ওর প্রতিটি শব্দ মীরার আত্মবিশ্বাসের ওপর একটা ছোট আঘাতের মতো লাগত। তখন মীরা দুঃখে শুধু নিরবে চোখের জল ফেলত। সে জানত যে প্রতিবাদ করলে স্যান্ডি ওকে স্কুলে ড্রপ করার সময় রাস্তাতেই অথবা স্কুলের গেটের সামনেই সবার সামনে অপমান করবে, যাতে ওর ছাত্র আর সহকর্মীরাও শুনতে পায়। ওটা সে ইচ্ছা করেই করত।
এক সন্ধ্যায় স্যান্ডির একটা পার্টিতে যাওয়ার ছিল। মীরা স্যান্ডির প্রিয় জামা ইস্ত্রি করে রেখেছিল, কিন্তু কলারের কাছে সামান্য একটু ভাঁজ থেকে গিয়েছিল। স্যান্ডি জামাটা তুলেই অবজ্ঞার সাথে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। "দেখো! একটা সামান্য কাজও তুমি ঠিক করে করতে পারো না। কোনো কাজই তুমি মন দিয়ে করো না," সে গর্জে উঠল। মীরা যখন চুপচাপ জামাটা তুলল, স্যান্ডি ফিসফিস করে বলল, "থাক, আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না। জানি তুমি আমার কত খেয়াল রাখো।" মীরা কথাটা না শোনার ভান করে জামাটা আবার ইস্ত্রি করে দিল। যখন সে নিজেও তৈরি হচ্ছিল, তখন ওর মনে হচ্ছিল পার্টিতে না গেলেই বুঝি ভালো হতো। কিন্তু সে জানত কিছু একটা ঘটবেই। যদি সে সাধারণ সাজে যায়, তবে স্যান্ডি বলবে ওর সম্মানের কোনো পরোয়া নেই; ভালো করে সাজলে বলবে মীরা শুধু নিজের কথা ভাবে; আর যদি না যায়, তবে বলবে বাচ্চার মতো জেদ করে ও সবার নজর কাড়তে চাইছে। আর যদি মীরা নিজে থেকে যাওয়ার উৎসাহ দেখায়, তবে বলবে সে মীরাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার যোগ্য মনে করে না, তাও দয়া করে নিয়ে যাচ্ছে। তাই মীরা এক প্রকার যন্ত্রের মতো তৈরি হয়ে স্যান্ডির সাথে বেরিয়ে পড়ল, কিন্তু মনের কোণে এক অদ্ভুত ভয় লেগেই রইল।
মীরা সবথেকে বেশি হতাশ হতো যখন ওদের মধ্যে কোনো অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটত। সেই ক্ষণিকের ঘনিষ্ঠতার পরেই স্যান্ডি কোনো এক 'অদ্ভুত' প্রসঙ্গ তুলে আনত। একবার এমনই এক মুহূর্তের পর স্যান্ডি হঠাৎ রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে বলল, "মা কি আজ ঠিকে ঝি-কে দিয়ে ঝাঁট দেওয়ালো? তুমি তো তোমার নতুন দুনিয়ায় আছো, মায়ের কোনো কাজের চিন্তা তো তোমার নেই।" এইভাবে সে মীরাকে অপরাধবোধের দিকে ঠেলে দিত। মীরা বলেছিল যে কাজের মাসিকে তো রাখা হয়েছে যাতে ঘরের কাজগুলো হয়। তাও স্যান্ডি বলত এই সব কাজ মীরার করা উচিত ছিল, আর কাজের লোক রাখা মানে মীরার নবাবী, কারণ সে সামান্য কিছু টাকা রোজগার করে বলে দেমাক দেখাচ্ছে। মীরা বুঝত না সে কী করবে। কাজের মাসি শুধু সকালে সাহায্য করত, বাকি কাজ মীরা স্কুল যাওয়ার আগে বা ফিরে এসে একাই সামলাত। স্কুল আর ঘরের কাজ মীরাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে দিচ্ছিল। তার ওপর স্যান্ডির খোটা ছিল আগুনের ওপর ঘৃতাহুতির মতো। মীরা অনেকবার শাশুড়ি মা আর শ্বশুর মশাইয়ের সাথেও কথা বলেছিল। এমনকি সাহস করে স্যান্ডিকেও বলেছিল। কিন্তু ফল কিছুই হয়নি, উল্টে মীরাকে স্যান্ডির হাতে চড় খেতে হয়েছিল।
এইভাবেই চলছিল। একবার শাশুড়ি মা যখন ভালোবেসে মীরার জন্মদিনে একটা উপহার দিলেন, স্যান্ডি মুহূর্তের মধ্যে পরিবেশটা বিষিয়ে দিল। "দেখলে! শুধু আমার মা-ই তোমাকে এত ভালোবাসেন, আর তোমার কোনো কদর নেই," সে টিপ্পনী কাটল, "তোমার বাড়ির লোক কোনোদিন কাউকে সম্মান করতে শেখেনি। ওরা তোমাকে কিছু 'শেখায়নি'।" মীরা বলল যে তুমি আমার সাথে বাপের বাড়ি চলো, বাবা-মাকেও তোমার জন্য কিছু করতে দাও, তখন স্যান্ডি ধমক দিয়ে বলল, "থাক থাক, জানি কত কী করে। হুহ! আমি ওখানে গিয়ে তোমাদের মতো ভিখারি লেবারদের মতো সেদ্ধ ছোলা খেয়ে দিন কাটাতে পারব না..." নিজের জন্মদিনে বাবা-মায়ের প্রতি এমন অপমান শুনে মীরা কেবল চোখের জল ফেলল। সে জানত প্রতিবাদ করলে স্যান্ডি হয়তো গায়ে হাত তুলবে। ওকে ছোট করার কোনো সুযোগ সে ছাড়ত না।
মীরার গল্প লেখার খুব শখ ছিল। অবসর সময়ে সে প্রায়ই গল্প লিখত। স্কুলের এক সিনিয়র সহকর্মীর অনুপ্রেরণায় মীরা একটি জাতীয় স্তরের গল্প প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছিল। মীরা তাতে অংশ নিল এবং সৌভাগ্যবশত সে দ্বিতীয় স্থান পেল। মীরার কাছে এটা ছিল অনেক বড় আনন্দ। সে ঠিক করল এই খবর সবার সাথে ভাগ করে নেবে। বাবা-মায়ের পাশাপাশি সে স্যান্ডিকেও জানাল। কিন্তু স্যান্ডি অবজ্ঞার সাথে বলল, "এত ওড়ার কী আছে? এ সব ছেলেমানুষি। তুমি ছোট জিনিসকে বাড়িয়ে দেখাতে ভালোবাসো। দ্বিতীয় হয়েছ তাতে কি সাহিত্যিক হয়ে গেলে নাকি? ফালতু গল্প লেখা ছাড়ো আর স্কুলের চাকরিতে মন দাও, ওখান থেকে দু'পয়সা আসে। তোমার এই আজেবাজে গল্প আমাদের পেট ভরাবে না।" মীরা খুব ভেঙে পড়ল। সে স্যান্ডিকে জিজ্ঞেস করল সে কেন এমন কথা বলে? কেন তাকে বারবার অপমানিত করে? সে কি ওকে ভালোবাসে না? তখন স্যান্ডি বলল, "তুমি তো ভালোবাসার যোগ্যই নও। তুমি শুধু স্বার্থপর।" মীরা যখন এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করল, স্যান্ডি রাগে আগুন হয়ে ওকে দেখল এবং এক মুহূর্তেই ওকে 'পাগল' (মেন্টাল) বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
মীরা শিক্ষিত এবং যুক্তিবাদী ছিল, কিন্তু স্যান্ডি ওকে প্রতিনিয়ত 'গঁওয়ার' (অশিক্ষিত) বলে ওর আত্মবিশ্বাস ভেঙে দিত।
এরই মধ্যে ওদের বিবাহবার্ষিকী এল। বাড়ির চাপে স্যান্ডি মীরাকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিল। মীরার মনে হলো হয়তো এটাই পরিবর্তনের শুরু। ওরা শহরের বাইরে বেড়াতে গেল। যাত্রা ভালোই কাটল, কিন্তু বাড়ি ফিরতেই স্যান্ডির প্রবল রাগ ফেটে পড়ল। "জানো কত টাকা খরচ হলো? আমার কত কষ্ট হলো? শুধু তোমার জন্য আমায় এই সব করতে হয়," সে চিৎকার করে দয়া দেখানোর ঢঙে বলল। তারপর আবার তর্জনগর্জন করে মীরাকে চা করতে বলল, যাতে মীরা বেড়াতে যাওয়ার 'উপকারের' অপরাধবোধ থেকে ভয়ে তড়িঘড়ি ঘরের সব কাজে লেগে পড়ে। মীরা শেষ পর্যন্ত সেটাই করল যা স্যান্ডি চেয়েছিল। কিন্তু মীরা আর সহ্য করতে পারছিল না। স্যান্ডির প্রতি ভালোবাসা আর নিজের জন্য স্যান্ডির কাছে ভালোবাসা পাওয়ার সব আশা ওর ভেঙে গিয়েছিল।
সময়ের সাথে সাথে মীরার চোখের সামনে থেকে স্যান্ডির মোহ কেটে গেল। সে বুঝল এটা ভালোবাসা নয়, শোষণ। সে নিজের খুশির ছোট ছোট মুহূর্তগুলো স্যান্ডির থেকে লুকিয়ে বাঁচতে শুরু করল। সে স্যান্ডির চালবাজিগুলো এখন কৌশলে সামলানো শুরু করল। ও যখন খোটা দিত, মীরা শান্ত থাকত, কোনো আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া দেখাত না। সে ঘরের কাজও দ্রুত সেরে ফেলত। স্যান্ডি যতক্ষণ ঘরে থাকত না, সে শান্তিতে থাকত আর নিজের মনকে ইতিবাচক ভাবনায় ভরিয়ে দিত।
এই মৌন প্রতিরোধ স্যান্ডি সহ্য করতে পারল না। সে মীরাকে সরাসরি বলল, "আমি জানি তুমি কী করছ। তুমি তোমার হাবভাব দিয়ে দুনিয়াকে আমার বিরুদ্ধে করতে চাইছ।" ওর ব্যবহার আরও রুক্ষ হয়ে উঠল। কিন্তু মীরা এবার মনে মনে প্রস্তুত হতে শুরু করেছিল।
অবশেষে সেই সুযোগও মীরা পেল। এক বড় পারিবারিক অনুষ্ঠানে স্যান্ডি বরাবরের মতো সবার সামনে 'আদর্শ স্বামী' সাজার নাটক করছিল। সে মীরার হাত ধরে বলল, "মীরা কত মিষ্টি, সবসময় আমার পরিবারের কথাই ভাবে।" তারপর সে হেসে একটা ছোট কিন্তু অপমানজনক রসিকতা করল যা ছিল পুরোপুরি ঘরের ব্যক্তিগত বিষয়।
ব্যস! মীরার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে স্যান্ডির চোখের দিকে তাকাল এবং সেখানেই সবার সামনে শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বলল:
"স্যান্ডি, তুমি সবার সামনে আমার এত কদর করছ, সেটা খুব ভালো। কিন্তু ঘরের ভেতরের সত্যিটাও জরুরি। যদি তুমি সত্যিই আমায় কদর করতে, তবে হয়তো আমায় বারবার 'গঁওয়ার' বলতে না, আমার বাবা-মাকে দোষ দিতে না যে ওরা আমায় কিছু শেখায়নি। আর আমায় 'মেন্টাল' বলে তো তুমি আমার সমস্যার সমাধান করো না। আর তোমার এই বাইরে এক আর ভেতরে আর এক— এই দুমুখো রূপটা নিয়ে কতদিন ঘুরবে? এটা তোমার বাড়ির লোকেরাও ভালো করে জানে। কিন্তু ওনারাও চুপ করে আছেন, কেন জানি না? ওনারা কেন বুঝতে পারছেন না যে ওনাদের ছেলে নিজের স্ত্রীকে মানসিক যন্ত্রণা দিতে দিতে তার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে।"
পুরো হলঘরে নিস্তব্ধতা নেমে এল। স্যান্ডির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ওর মুখোশটা, যা বছরের পর বছর মানুষকে ধোঁকা দিয়ে আসছিল, এক পলকে নিচে খসে পড়ল।
মীরা অবশেষে সেই বিষাক্ত বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার প্রথম সাহসী পদক্ষেপটা নিয়ে ফেলল। দুনিয়ার সামনে স্যান্ডির আসল 'দ্বিতীয় মুখ'টা দেখিয়ে সে নিজের আত্মসম্মানের পথ বেছে নিল। পরের কয়েকদিন বাড়িতে অনেক ঝগড়াঝাঁটি হলো এবং মীরার বাবা-মাকেও ডাকা হলো। কিন্তু মীরা এবার সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। সে স্যান্ডির থেকে বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল।
— ডঃ মধুছন্দা চক্রবর্তী
বেঙ্গালুরু
कोई टिप्पणी नहीं:
एक टिप्पणी भेजें
Thank you for your support